সুভাষ মুখোপাধ্যায়
Table of Content:
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯ - ২০০৩)
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি ও গদ্যকার। তিনি রবীন্দ্রত্তোর যুগের কবি, আধুনিক কবি। কবিতা তার প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র হলেও ছড়া, রিপোর্টাজ, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য সকল প্রকার রচনাতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
জন্ম ও পরিবার:
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মাতা যামিনী দেবী। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতায়। নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, "আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়।' ছেলেবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ের থেকে গ্রন্থাগারের বইয়ের প্রতি তার অধিক আগ্রহ ছিল।
শিক্ষাজীবন:
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাজশাহীর নওগাঁর মাইনর স্কুলে। তারপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। পরবর্তীকালে তিনি ভর্তি হন সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। পরবর্তীকালে তিনি আশুতোষ কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন:
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় মেট্রিক পাশ করার পর। ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এ সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন তিনি। কবি সমর সেন তাকে হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম নামে একটি গ্রন্থ দেন, এটি পড়েই তিনি মার্কসীয় রাজনীতিতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি লেবার পার্টিতে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন, ১৯৪২-এ পার্টির সদস্য হন। এইসময় সদ্যগঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে তিনিও কারাবরণ করেন, ১৯৫০ সালে মুক্তি পান তিনি। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে তিনি পুরনো পার্টিতে থেকে যান। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার ফলে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে শেষজীবনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানালেও পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেননি। ১৯৮১ সালে রণকৌশল ও অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক কারণে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে বামপন্থী রাজনীতি ত্যাগ করে তিনি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে যান, তারজন্য তিনি বহুবার সমালোচিত হয়েছেন।
কর্মজীবন:
কিশোর জীবন থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার ফলে তার স্থায়ী কর্মজীবন বলে কিছু ছিল না। প্রথমে তার রাজনৈতিক পার্টি নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হলে কিছুদিন তাকে কারাবন্দি থাকতে হয়, পরবর্তীকালে তিনি সাব-এডিটরের চাকরি পান। ১৯৫১ সালে সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।কিছুকাল তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সন্দেশ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের কাজও করেছেন। ১৯৫১ সালে তিনি সুলেখিকা গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সাহিত্যিক জীবন:
তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর শিল্পীসত্তার আত্মপ্রকাশ অত্যন্ত শিশুবয়সে। স্কুলে পড়াকালীন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তার লেখা প্রকাশিত হতো। কবি হয়ে উঠার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কবি কালিদাস রায় এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক মুরলীকৃষ্ণ বসুর কাছ থেকে। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "পদাতিক'। সহজ সরল ভাষায় গূঢ় ব্যঞ্জনাধর্মী কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর কাব্যভাষা আড়ম্বরহীন। আড়ম্বরহীন ভাষাতেই তিনি রচনা করেছিলেন চিরকুটের মতো ফ্যাসিবিরোধী কাব্য। কমিউনিজমে বিশ্বাসী কবি মানুষের শোষণ মুক্তির জন্য বহু কবিতা লিখেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় আশাবাদী কবি। দুঃখ, বেদনা লাঞ্চনা ও অপরিসীম নৈরাশ্যে ভারাক্রান্ত হয়েও তিনি রাতের গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনা ফুটন্ত সকালের প্রত্যাশা করেছেন। তাই তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এই আশার বাণী- "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।'
দীর্ঘকাল তাঁর কবিতায় সাম্যবাদী ভাবধারা প্রকাশিত হয়েছে। বিষ্ণু দে-র মতো কুলীন বুদ্ধিজীবি সাম্যবাদী তিনি নন, আবার সমর সেনের মতো ব্যঙ্গ তীক্ষ্ণ নৈরাশ্যবাদী সাম্যবাদীও তিনি নন। আবেগ উদ্দীপনা ব্যঙ্গ বিশ্বাস সব মিশে গিয়েছিল তাঁর কবিতায়,