মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
☰Fullscreen
Table of Content:
জন্ম ও শৈশব: ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকায়
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃকবাড়ি ছিল ঢাকা বিক্রমপুরের অন্তর্গত মালবদিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছিল হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তাই চাকুরিসূত্রে তাঁর বাবাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব কেটেছে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাকনাম মানিক। এই ডাকনামেই পরবর্তীকালে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি খ্যাত হয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন: কলকাতা থেকে মানিকের বাবা টাঙ্গাইলে বদলি
হওয়ায় মিত্র স্কুলের ছাত্র মানিক টাঙ্গাইল জেলা স্কুলে ভরতি হন। প্রতিবারই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত মাঝিদের নৌকায় বা গাড়োয়ানদের গাড়িতে অথবা আস্তাবলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। মেদিনীপুরে থাকাকালীন মানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে পাস করেন। বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইএসসি পাস করেন। ওই বছরই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি গণিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি-তে ভরতি হন। কলেজজীবনে গান গাওয়া, বাঁশি বাজানো এসবের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক লক্ষ করা যায়। সাহিত্যচর্চার নেশা তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, তিনি একসময় প্রথাগত পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
কর্মজীবন
সাহিত্যজীবন: সাহিত্যের জগতে মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল কিছুটা হঠাৎ করেই। তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তখন একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় নামি পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপানোর প্রসঙ্গ ওঠে। কথাপ্রসঙ্গে মানিকের এক বন্ধু বলেছিলেন যে, নামকরা লেখক না হলে বিখ্যাত পত্রিকাগুলো লেখা ছাপায় না। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, ভালো লেখা হলে অনামি লেখকের রচনাও নিশ্চয়ই ছাপা হবে। বন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক বাধলে মানিক তাঁদের বলেন যে, তিন মাসের মধ্যেই তিনি তাঁর কথা প্রমাণ করবেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই 'অতসী মামী' নামে একটি গল্প লিখে তখনকার নামি পত্রিকা বিচিত্রা-র অফিসে জমা দেন। লেখক হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটিই তিনি সেখানে ব্যবহার করেন। যথাসময়ে সেই গল্পটি ছাপা হয় এবং তা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এইভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবনের শুরু। 'অতসী মামী' গল্পটি প্রকাশের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে মানিকের কাছে লেখার জন্য ডাক আসতে থাকে। তিনিও মনপ্রাণ দিয়ে লিখতে থাকেন। সাহিত্যচর্চাতেই তিনি বেশি করে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক নিযুক্ত হন। কিন্তু পত্রিকার মালিকের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই সেই চাকরি থেকে তিনি ইস্তফা দেন। এরপর মানিক তাঁর ছোটো ভাই সুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে 'উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস' নামে এক প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস এবং ছোটোগল্প দুই-ই রচনা করেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর সমান দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা ছোটোগল্পের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দিবারাত্রির কাব্য বইটি তিনি একুশ বছর বয়সে লিখেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল-জননী (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), দর্পণ (১৯৪৫), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১), সোনার চেয়ে দামি (১৯৫১), ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২), হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬) ইত্যাদি। তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), ভেজাল (১৯৪৪), আজ, কাল, পরশুর গল্প (১৯৪৬), লাজুকলতা (১৯৫০) ইত্যাদি।
বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বাস্তবজীবন ও দর্শনকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর রচনার মধ্যে মার্কসীয় দর্শন ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রভাব রয়েছে।
শেষজীবন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যজীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে। সংক্ষিপ্ত জীবনকালে বারবার নানাপ্রকার অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।