ভাববাদের মূলনীতি (Tenets of Idealism)
Table of Content:
ভাববাদের মূলনীতি (Tenets of Idealism)
ভাববাদের মূল নীতিগুলি হল-
1. ভাববাদী দার্শনিকরা মানুষ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক ভাবমূলক সত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই মত অনুযায়ী দৃশ্যমান জড় জগৎ ছাড়াও আরও একটি জগৎ আছে, তা হল আধ্যাত্মিক জগৎ। জড় জগৎ অপেক্ষা আধ্যাত্মিক জগৎ অধিকতর সত্য বা বাস্তব। দৃশ্যমান জগৎ অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল ও মিথ্যা। আমাদের মন ও আত্মা জড় জগতের সৃষ্টিকর্তা।
2. আধ্যাত্মিক জগৎ হল প্রকৃত সত্য এবং অবিনশ্বর। আধ্যাত্মিক জগৎ শাশ্বত ও নিত্য। আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়েই এই আধ্যাত্মিক জগৎ। এই জগতের অধিকর্তা হলেন সর্বজনীন মনের অধিকারী ভগবান বা ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হলেন চিরন্তন সত্য। মানুষের মন বা আত্মা হল এই সর্বজনীন মনের বা আত্মার অংশমাত্র। ব্যক্তি বা জীবাত্মা যখন ব্রহ্ম বা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে পারে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি লাভ করতে পারে তখন তার মোক্ষ লাভ হয়।
3. ভাববাদীরা মনে করেন যে, বহিঃপ্রকৃতির চেয়ে মানুষের মনই বেশি বিবেচনাযোগ্য। কারণ মূল সত্তার স্থান মানুষের মনেই, বহির্বিশ্বে নয়। কাজেই তাকে চিনতে হলে মন দিয়ে চেনার সাধনা করতে হবে। বাইরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
4. ভাববাদীদের মতে, বিশ্ব এক প্রাণময় সত্তা যার শরীর ও আত্মা বা মন আছে। ভাববাদীরা মানুষের মন বা আত্মাকে শরীর থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে শরীর বা দেহ মরণশীল, তাই মিথ্যা। কিন্তু আত্মা সত্য কারণ আত্মা অবিনশ্বর।
5. প্রকৃতিবাদীরা জৈবিক সত্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ভাববাদীদের কাছে তার বিশেষ মূল্য নেই। মানুষের চিন্ময় সত্তা হল তার প্রকৃত সত্তা যা হল আধ্যাত্মিকতা। মানুষের চিন্ময় আধ্যাত্মিক সত্তা তার একটি অতিরিক্ত গুণ নয়, এটি তার মূল স্বভাব ও সত্তা।
6. ভাববাদ বিশ্বাস করে যে, বিশ্ব হল নিয়মের রাজ্য। যুক্তিগ্রাহ্য মানুষ এই বিশ্বের গভীরে একটি ক্ষুদ্র প্রাণী। তার অন্তরে রয়েছে সুশৃঙ্খল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ঝোঁক। প্রাণী হিসেবে তার ভিতরে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সূত্র লক্ষ করা যায়। তার সমস্ত বুদ্ধি, মেধা, ইচ্ছা, স্মৃতি, কল্পনা সবই সেই একমুখী।
7. ভাববাদীরা কতকগুলি পূর্বনির্দিষ্ট, স্থির ও চিরায়ত আদর্শ বা মূল্যবোধে বিশ্বাসী। তাঁদের মতে, জগতে কতকগুলি আধ্যাত্মিক মূল্যের অস্তিত্ব রয়েছে। যেগুলি সঠিক ও সত্য। এই আধ্যাত্মিক আদর্শগুলিকে সত্য, সুন্দর ও শুভ-এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ভাববাদীদের মতে, মানুষ বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও নৈতিক-এই তিনটি ক্রিয়াকে অনুসরণ করে থাকে। এ ছাড়া জীবনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। এঁদের মত অনুযায়ী প্রতিটি আদর্শ অদ্বিতীয়। ভাববাদী দার্শনিকেরা শুভ, সত্য ও সৌন্দর্যকে পরম (absalute) বলে মনে করে। এই আদর্শ তিনটি নিজের স্ব স্ব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পূর্ণ এককভাবে কাঙ্ক্ষিত।
৪. ভাববাদীরা অতীন্দ্রিয় সত্তায় বিশ্বাসী। তাঁদের মতে, একমাত্র ভাব বা ধারণাই সত্য। মন বা আধ্যাত্মিক শক্তি জড় বস্তু অপেক্ষা অনেক বেশি সত্য ও মূল্যবান। জড় জগৎ ও অভিজ্ঞতার জগৎ-এর মধ্যে আদানপ্রদান চলে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টাই পারমার্থিক সত্তার বেশি নিকটবর্তী। পারমার্থিক সত্তার রূপ জড় নয়। চিন্ময় অভিজ্ঞতার জগৎ বহির্জগৎ অপেক্ষা বেশি মূল্যবান। কারণ মনই হল অজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার কর্তা। এই জন্য ভাববাদীরা মানববিদ্যাকে (Humanities) অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান হতে শিক্ষার দিক থেকে অনেক বেশি মূল্যবান বলে মনে করেন।
9. ভাববাদীদের মতে, মানুষ একটা আধ্যাত্মিক সত্তা নিয়ে জন্মায় এবং মানুষের এই আধ্যাত্মিক সত্তা তাকে মানবেতর প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। আধ্যাত্মিকতা হল মানবতার সার সত্তা। আত্মা বা মন পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ (Spiritual environment) সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁরা আরও বলেন যে, জগতের সমস্ত জড়বস্তুর মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের ক্ষমতা।
10. ভাববাদীরা বলেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ডের মূল কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি হল মানুষ। মানুষের আত্মিক শক্তি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর মর্যাদা আরোপ হল ভাববাদীদের সার কথা। মানুষের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা ও মূল্য ভাববাদে বিশেষভাবে স্বীকৃত। এঁরা ব্যক্তিত্বের সমৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। এঁরা মনে করেন মানুষের ব্যক্তিত্ব অমূল্য ও তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
11. ভাববাদীদের মতে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান (Spiritual knowledge) হল প্রকৃত জ্ঞান এবং প্রকৃত জ্ঞান শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। এঁরা মনে করেন জড় বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অপেক্ষা মানবশাস্ত্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মতে, জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে অন্তদৃষ্টি (Intuition), মনসংযোগ (Concentration), ধ্যান (Meditation), আত্মোপলব্ধি (Self-realisation) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।