ভাষার বিকাশ
Table of Content:
মানব শিশুর জীবনে ভাষার বিকাশ একটি জটিল প্রক্রিয়া। শিশু কথা বলার আগে কথা বুঝতে পারে। ভাষার বিকাশে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট স্তর দেখা যায়। স্তর গুলো হচ্ছে ধ্বনি, কলকূজন, অঙ্গভঙ্গিমা সহজশব্দ উচ্চারণ, এশশব্দে বাক্য, দুতিন শব্দে বাক্য ইত্যাদি। প্রথম ধ্বনি কান্না। চার পাঁচ মাসে কিছু অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ Cooing babbling করে থাকে। অনুকরণ পুনরাবৃত্তির স্তরে শিশু শোনা শব্দ বার বার উচ্চারণ করে। যদি ও সে তার অর্থ বোঝে না। এ সময়ে সে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়। ৯/১০ মাসে শিশু অন্যের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য নানা ধরনের শব্দ করে। ১২/১৩ মাসে সহজ কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এ পর্যায়ে সে ভাষার অর্থবোধের স্তরে পৌঁছায়। ১২-১৮ মাসে এক শব্দের বাক্যে অসম্পূর্ন বাক্যে নিজেকে প্রকাশ করে। তিন বছরে স্বাভাবিক শিশুর দ্রুত গতিতে শব্দ শিখে ও শব্দের ভান্ডার বৃদ্ধি করতে থাকে।
Eric Lenneberg পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার শিশুদের ভাষা বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি স্বাভাবিক শিশুদের ক্ষেত্রে ভাষার বিকাশে কতগুলো নিয়মিত, ধারাবাহিক ও নির্দিষ্ট বিকাশের ধরণ আবিষ্কার করেন। এই বিকাশের ধরণ পৃথিবীর সর্বত্র, সকল সাংস্কৃতিক পরিবেশে একই রকম। লেনেবার্গের মতানুযায়ী বিভিন্ন বয়সের ভাষার বিকাশ নিম্নরূপ হয়ে থাকে।
বয়স | ভাষার বিকাশ |
১২ সপ্তাহের শেষে | শিশুর আট সপ্তাহের দিকের কান্নার সময়ে উলে-খযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এসময়ে তার সঙ্গে কথা বললে হাসে, কূজন (cooing) করে। এই কূজন আ-আ-উ-উ ধ্বনির মত। ১৫/২০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। |
১৬ সপ্তাহের শেষে | বিভিন্ন শব্দে সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া করতে দেখা যায়। কথা শুনলে মাথা ঘুরায়, চোখ বক্তাকে খোজে। কখনও কখনও কূজন ধ্বনি করে। |
২০ সপ্তাহের শেষে | কূজনের স্বরধ্বনি ছাড়িয়ে কিছুটা অন্য ধরনের শব্দ উচ্চারন করে। পরিবেশের ভাষার সঙ্গে তার কোন মিল থাকে না। |
৬ মাসের শেষে | কূজন কমতে থাকে। এক ধ্বনির শব্দাংশের উচ্চারণ দেখা যায়। যেমন মা,মু, দি,দা ইত্যাদি। |
৮ মাসের শেষে | শব্দের পুনরাবৃত্তি করে। |
১০ মাসের শেষে | গলায় বিভিন্ন আওয়াজ নিয়ে শব্দ খেলা করে। এ সময়ে প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝা যায় বিভিন্ন শোনা কথার পার্থক্য সনাক্ত করতে পারছে। |
১২ মাসের শেষে | মামা, দাদা, বাবা ইত্যাদি বলতে পারে। অনেক কথা বুঝতে পারে। |
১৮ মাসের শেষে | অনেক শব্দ (তিনের বেশি ও পঞ্চাশের কম) বলতে পারে। দু'একটি শব্দের আধো আধো বাক্য বলতে পারে। এ সময়ে বুঝার শক্তি দ্রুত বাড়তে থাকে। |
২৪ মাসের শেষে | শব্দকোষ অনেক বেড়ে যায়। অনেক শিশু এসময় আশেপাশের সব জিনিসের নাম বলতে পারে। দুই তিন শব্দ একত্রিত করে নিজের ধরনের শিশু বাক্যে নিজেকে প্রকাশ করে। এ সময়ে কথা বলার আগ্রহ বেশি দেখা যায়। |
৩০ মাসের শেষে | প্রতি দিন দ্রুত শব্দ ভান্ডার বাড়তে থাকে। যোগাযোগ করার প্রচন্ড ইচ্ছা দেখা যায়। বড়রা তাদের কথা না বুঝলে বিরক্ত হয়। দুই-তিন কখনও চার পাঁচ শব্দে বাক্য প্রকাশ করে। বাক্য, বাক্যাংশ সব কিছুতেই শিশু ভাষার বৈশিষ্ট্য থাকে। এ সময় তদের যা বলা হয়, মোটামুটি সব বুঝে। |
৩ বছরের শেষে | শব্দ ভান্ডার হাজার শব্দে পৌঁছায়। তাদের কথার শতকরা ৮০ ভাগই অপরিচিতরাও বুঝতে পারে। |
৪ বছরের শেষে | ভাষার বিকাশ সম্পর্ণতার দিকে যেতে থাকে। এ সময়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভাষার নর্মের সঙ্গে তাদের ভাষার পার্থক্য শুধু স্টাইলে, ব্যকরণে নয়। |
লেনেবার্গ এর গবেষণায় দেখা যায় শিশুর সঞ্চালন মূলক বিকাশের সঙ্গে তার স্বর ভাষার (Vocalization and language) বিকাশের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।*
কোন বয়সে শিশু কি পরিমান শব্দ আয়ত্ত করে থাকে সে সম্পর্কে স্মিথ পরীক্ষা পরিচালনা করেন। তার একটি পরীক্ষণ থেকে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সে ছেলেমেয়েরা নিম্নোক্তভাবে শব্দ ভান্ডারের অধিকারী হয়।
* Lenneberg, Eric, Biological Foundations of Language, New York, Wiley, 1967
বয়স | শব্দভান্ডার | |
বছর | মাস | শিশুর গড় শব্দের সংখ্যা |
০ | ৮ | ০ |
০ | ১০ | ১ |
১ | ০ | ৩ |
১ | ৩ | ১৯ |
১ | ৬ | ২২ |
১ | ৯ | ১১৮ |
২ | ০ | ২৭২ |
২ | ৬ | ৪৪৬ |
৩ | ০ | ৮৯৬ |
৩ | ৬ | ১২২১ |
8 | ০ | ১৫৪০ |
8 | ৬ | ১৮৭০ |
৫ | ০ | ২০৭২ |
৫ | ৬ | ২২৮৯ |
৬ | ০ | ২৫৬২ |
Smith M.E., In Investigation of the Development of the Sentence and of the Extent of the vocabulary of Young children. University of Iowa, study of child welfare, 1926, 3 No 5.
স্মিথের এই তথ্য থেকে বুঝা যায় ছেলেমেয়েদের শব্দ ভান্ডার অতি দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। প্রাপ্ত বয়ষ্কের গড় শব্দ ভান্ডার ধরে দেখা যায় ৬ বৎসর বয়সে সম্ভাব্য শব্দ ভান্ডারের শতকরা
২২ ভাগ অর্জিত হয়। বাল্যের শেষ প্রান্তে ১১ বৎসর বয়সে গড় শব্দ ভান্ডার ৬৯০০ তে উন্নীত হয় (শতকরা ৬০ ভাগ)। কৈশোর শেষ হওয়ার আগেই সম্ভাব্য গড় শব্দ ভান্ডারের শতকরা ৮০ ভাগ অর্জিত হয়ে যায়।
স্মিথের এই গবেষণালব্ধ ফলের সঙ্গে Watts এর পরীক্ষণের মোটামুটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বয়স | Watts এর প্রথম পরীক্ষণ | Watts এর দ্বিতীয় পরীক্ষণ |
শব্দ ভান্ডার | শব্দ ভান্ডার | |
৪-৪ and ১/২ বছর | ১৭৬০ | ২৭১২ |
৪ and ১/২- ৫ বছর | ২০৮০ | ২৯১০ |
Watts A.F, The Language and Mental Development of Chilaren, Loudin : Harrap, 1948.
ভাষা বিকাশের বৈশিষ্ট্য
- ভাষার বিকাশের হার শিশুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল।
- ভাষার বিকাশ তিন থেকে আট বছরের মধ্যে খুব বেশি পরিমানে হয়।
- ভাষার বিকাশের দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের থেকে সব সময় এগিয়ে থাকে।
- ভাষার বিকাশের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয়।
- পড়তে শেখার আগে কথা বলার ক্ষমতার বিকাশ হয়।
- শৈশবের প্রথম পর্যায়ে শিশুরা আন্তকেন্দ্রিক থাকে বলে সব সময় নিজ সম্পর্কে বেশি কথা বলে। শৈশবের শেষ পর্যায়ে সামাজিক কথোপকথন করতে পারে। খেলার জগতে সঙ্গীসাথী বৃদ্ধি পেলে শিশুর নিজ সম্পর্কে বলার প্রবনতা কমে ও সামাজিক কথোপকথন শুরু হয়।
- একবার কথা বলতে সক্ষম হলে শৈশবের প্রথম পর্যায়ে শিশুরা অবিরাম কথা বলতে
- ভালবাসে।
- শিশুর বুদ্ধি যত প্রখর হয় কথা বলার কৌশল সে তত তাড়াতাড়ি আয়ত্ত্ব করে।
ভাষার বিকাশের সহায়ক
শিশুর ভাষার বিকাশে পরিবারে অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাড়াতাড়ি শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে শিখে। কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মা শিশুকে শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে উৎসাহিত করেন। বাবা মার সঙ্গে শিশুর মৌখিক সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়।
শিশুর যখন আধো আধো কথা বলতে শুরু করে তখন থেকেই ভাষার বিকাশের পরিচালনা প্রয়োজন।
শিশুদের সঠিক শব্দ উচ্চারণে সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করা উচিত। সঠিক শব্দযোগে শুদ্ধ বাক্য গঠনে তাদের সাহায্য করতে হবে।
শিশুকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। শিশুর সাথে আলাপ করার সুযোগ দিতে হবে। শিশুর সাথে আলাপ করা, প্রশ্ন করা, উত্তর দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শিশুর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এতে শিশু কথা বলতে উৎসাহিত হবে।
নতুন শব্দের অর্থ বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি পাবে। শিশুর ভাষার বিকাশে অনুকরণ হচ্ছে একটি প্রধান উপাদান। শিশুরা বড়দের অনুকরণ করে। শিশুর সঙ্গে যে ভাবে কথা বলা হবে, শিশু সেভাবেই কথা বলতে শিখবে। অনুকরণ করার জন্য সুষ্ঠু আদর্শ নমুনা বা মডেল প্রয়োজন।
পরিবারের সকলে একত্রিত থাকলে শিশুকে সকলের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। শিশুকে গুরুত্ব দিয়ে সকলে তার সঙ্গে কথা বলবে, তার কথা শুনবে। শিশুর পারিবারিক পরিবেশ অনুকূল হওয়া দরকার। মায়ের হে ও সাহচর্য শিশুর ভাষার বিকাশকে উদ্দীপ্ত করে।
অনেক সময় অগঠিত চোয়াল, দাঁতের অসমতা, শ্রবণ শক্তির ত্রুটি ইত্যাদি শিশুর ভাষার সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাহত করে। এ সব ক্ষেত্রে সময় মত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।