সন্তানকে অভিশাপ না দেয়া
Table of Content:
সন্তানকে অভিশাপ না দেয়া
মা তার সন্তানকে অবর্ণনীয় কষ্টে গর্ভেধারণ করেন। অমানুষিক কষ্টে পৃথিবীর আলো-বাতাসে আনেন। তারপর নিজের ভালবাসা আর ত্যাগের সবটুকু উজাড় করে অসহায় একটি শিশুকে যথাক্রমে সুস্থ, সবল, সজ্ঞান ও স্বাবলম্বী করে তোলেন। সন্তান মানুষ করতে গিয়ে মা-বাবাকে যে কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয় তা শুধু মা-বাবারাই জানেন। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে এ কষ্ট আরও বেশি। এখানে রোজ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে টিকে থাকতে হয়।
অভাবের কারণে একজন নবীন মাকেও একহাতে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব আর অপরহাতে বুকের ধন সন্তানটিকে আগলে রাখতে হয়। অনেক 'মা আছেন যারা সময়মত বাচ্চার খাবারটিও যোগাতে পারেন না রুচিমত। বিশেষত যেসব বাচ্চা জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ পায় না। দরিদ্র পরিবারে এসব শিশুকে যে কত কষ্টে মা জননী বড় করে তোলেন তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। এ সময় মায়েদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়।
অথচ অনেক মা'কে এ সময় ধৈর্যহারাও হতে দেখা যায়। অনেক মা সন্তানের উপর বিরক্ত হয়ে তাকে অবলীলায় অভিশাপ দিয়ে বসেন। স্নেহময়ী জননী হয়তো তার জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানের যে কোনো অনিষ্ট রোধ করতে চাইবেন। কিন্তু তিনিই আবার রাগের মাথায় অবচেতনে আদরের সন্তানটির অনিষ্ট কামনা করে বসেন। প্রায়ই দেখা যায় সন্তানদের দুষ্টুমিতে অতিষ্ট হয়ে কোন কোন মা সরাসরি সন্তানের নানা রকম অনিষ্ট কামনা করে বসেন। যেমন:
• তুই মরিস না কেন? তুই মরলে ফকিরকে একবেলা ভরপেট খাওয়াতাম!
• আল্লাহ, আমি আর পারিনা, এর জ্বালা থেকে আমাকে নিস্তার দাও!
• তুই ধ্বংস হ!
• তুই জাহান্নামে যা!
• তুই যদি এরকম আবার করিস তাহলে আমার মড়া মুখ দেখবি!
এ জাতীয় বাক্য আমরা অহরহই শুনতে পাই। গর্ভধারিণী মা কখনোই তার সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না। কিন্তু অসচেতনভাবে কামনা করা দুর্ঘটনাও কখনো সত্য হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই এ সময় মাকে অনেক বেশি ত্যাগ ও ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়। ইসলাম কখনো কারো বিরুদ্ধে অভিশাপ দেয়া বা বদদু'আ করাকে সমর্থন করে না। আপন সন্তানকে তো দূরের কথা জীবজন্তু এমনকি জড় পদার্থকে অভিশাপ দেয়াও সমর্থন করে না। জাবির ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
বাতনে বুওয়াত যুদ্ধের সফরে রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে পথ চলছিলাম। তিনি মাজদী ইবন 'আমর জুহানীকে খুঁজছিলেন। পানি বহনকারী উটগুলোর পেছনে আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন, ছয়জন ও সাতজন করে পথ চলছিল। উকবা নামক এক আনসারী ব্যক্তি তাঁর উটের পাশ দিয়ে চক্কর দিল এবং তাকে থামাল। তারপর তার পিঠে উঠে আবার তাকে চলতে নির্দেশ দিল। উটটি তখন একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল। তিনি তখন বললেন ধুত্তুরি। তোর উপর আল্লাহর অভিশাপ। এ শুনে রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, নিজের উটকে অভিশাপদাতা এই ব্যক্তিটি কে? তিনি বললেন, আমি হে আল্লাহর রসূল। তিনি (রসূলুল্লাহ) বললেন, 'তুমি এর পিঠ থেকে নামো। তুমি আমাদের কোনো অভিশপ্তের সঙ্গী করো না। তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের সন্তান-সন্ততির এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে দু'আ করো না। তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুহূর্তের জ্ঞানপ্রাপ্ত নও, যখন যা কিছুই চাওয়া হয় তিনি তোমাদের তা দিয়ে দেবেন।' (সহীহ মুসলিম)
হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, অর্থাৎ তোমরা কোনো মুহূর্তেই নিজের বিরুদ্ধে, নিজের সন্তান বা সম্পদের বিরুদ্ধে বদদু'আ করো না। কারণ, হতে পারে যে সময় তুমি দু'আ করছো, তা দিনের মধ্যে ওই সময় যখন যা-ই দু'আ করা হোক না কেন তা কবুল করা হয়। তোমরা তো এ সময় সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত নও। (মুবারকপুরী, মিরআতুল মাফাতীহ)
'হাদীসটি রাগের মাথায় মানুষের তার পরিবার ও সম্পদের বিরুদ্ধে দু'আ করার নিষিদ্ধতা প্রমাণ করে। হাদীসটিতে এর কারণও তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো, দু'আ কবুলের কিছু বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে এবং তা ঠিক ঐ মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। ফলে সেই মুহূর্তে মানুষের সবই কবুল হয়ে যায় চাই তা ভালো হোক বা মন্দ হোক, যা সে তার পরিবার বা সম্পদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করে না।' (আবদুল মুহসিন, শারহু সুনান আবী দাউদ)
নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে দু'আ করার অর্থ তো নিজেই নিজেকে হত্যার তথা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া। আর এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
'আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।'
(সূরা বাকারা ২: ১৯৫)
অতএব প্রতিটি মাকে ভেবে দেখতে হবে, আমার রাগের মাথায় উচ্চারণ করা বাক্য যদি সত্যে পরিণত হয় তাহলে কেমন লাগবে? আমি কি তা সহ্য করতে পারব? এ জন্য রাগের মাথায়ও কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করা যাবে না। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে শুধু মায়েদেরই নয়, আমাদের সবারই উচিত নিজের, নিজের সন্তান ও সম্পদের বিরুদ্ধে বদদু'আ করা থেকে সংযত হওয়া। রাগের সময় সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়া।