জ্ঞান বিকাশের মতবাদ
Table of Content:
জ্যাঁ পিয়াজে জ্ঞান বিকাশের মতবাদ
আমেরিকায় আচরণবাদ নিয়ে যখন খুব মাতামাতি চলছিল যখন সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী প্রাথমিক ভাবে একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক (পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে একজন মনোবিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন) জ্যাঁ পিয়াজে (১৮৯৬-১৯৮০) মানুষের আচরণের এক নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি জ্ঞানের বিকাশকে বেছে নিলেন তাঁর গবেষণার প্রতিবাদ্য হিসাবে এবং জ্ঞান বিকাশের প্রক্রিয়া হিসাবেই আচরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পিয়াজে তাঁর সন্তানের উপর গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করলেন যে শিশুর জ্ঞানের বিকাশ মূলত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর এক যোগ্যতা। শিশু এই যোগ্যতা লাভ করে পরিবেশের বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার সাথে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে।
জ্ঞান বিকাশের স্তরসমূহ
জন্মের পর থেকেই শিশু তার জ্ঞানের বিকাশ সাধনের কাজে ব্রতী হয় তবে পিয়াজের মতে এই প্রক্রিয়া সারা জীবন ব্যাপি চলেনা বরং তা কৈশোর কাল পর্যন্ত গিয়ে স্থির হয়ে যায় অর্থাৎ জ্ঞানের কাঠামোগত আর কোন পরিবর্তন হয়না। যাইহোক এখানে আর সে আলোচনায় না গিয়ে আমরা পিয়াজের জ্ঞান বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলি নিয়ে আলোচনা করছি।
পিয়াজে মানুষের জীবনকে তার জ্ঞান বিকাশের দৃষ্টিকোন থেকে মোট চারটি সময়কালে ভাগ করেছেন। প্রতিটি শ্রেণীতে সময়ের যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে তা অনেকটা আনুমানিক বা একটা গড় হিসাব, তবে এই সময়কালের কোন সার্বজনীনতা নেই। কারো কারো ক্ষেত্রে বয়সের তারতম্য ঘটতে পারে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, সবাইকেই এই স্তরগুলি একে একে অতিক্রম করতে হয়, কোনটি বাদ দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। জ্ঞান বিকাশের স্তরগুলি হলো
- ইন্দ্রিয়-পেশীর সমন্বয়কাল (Sensorimotor Period) ০-২ বৎসর
- প্রাক-প্রায়োগিক কাল (Pre- operational Period) ২-৭ বৎসর
- বাস্তব প্রায়োগিক কাল (Concrete Operational Period) ৭-১১ বৎসর
- রীতিবদ্ধ প্রায়োগিক কাল (Formal Operational Period) ১১-১৫/১৬ বৎসর
পিয়াজে শিশুর জ্ঞান বিকাশের প্রথম স্তরকে আরো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য একে মোট ছয়টি উপস্তরে ভাগ করেছেন -
- প্রথম উপস্তরটি (জন্ম থেকে প্রথম মাস) প্রধানত শিশুর জন্য প্রতিবর্ত ক্ষমতা ব্যবহারের সময়। এ পর্যায়ে তার জ্ঞানীয় দক্ষতার খুব কমই প্রতিফলন পাওয়া যায়।
- দ্বিতীয় পর্যায়ে (২ থেকে ৪ মাস) শিশু তার প্রতিবর্ত ক্ষমতাকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে ব্যবহার করতে শিখে যেমন, আঙ্গুল চুষতে পারে, হাত-পা ছুড়ে কিছু ব্যক্ত করতে পারে ইত্যাদি।
- তৃতীয় উপস্তরে (৪ থেকে ৮ মাস) শিশুর যথেষ্ট মানসিক পরিবর্তন ঘটে যেমন, সে তখন তার পছন্দ মত কোন কিছু ধরে ছিনিয়ে নিতে চায়, হাতে ঝুমঝুমি পেলে তা বাজিয়ে দেখে, মুখে বিভিন্ন শব্দ তুলে পরীক্ষা করে।
- চতুর্থ উপস্তরে (৮ থেকে ১২ মাস) শারীীরিক ও মানসিক অনেক দক্ষতার বিকাশ ঘটে। পূর্বে শেখা প্রতিক্রিয়ার সাহায্যে সে এখন সমস্যার সমাধান করতে চায়, লক্ষ্যমুখী আচরণ করে এবং ইচ্ছা মত কোন জিনিস নেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালায়।
- পঞ্চম স্তরে (১২ থেকে ১৮ মাস) শিশু আরো জটিল প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারে। যেমন কোন কিছু শেখার জন্য বার বার প্রচেষ্টা চালায় এবং নতুন উপায় অবলম্বন করে তার সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করে অর্থাৎ নিজে কিছু করতে না পারলে আকার ইঙ্গিতে তা মাকে করতে বলে। তাছাড়া এ পর্যায়ে এসে শিশুর মধ্যে বস্তুর স্থায়িত্বের ধারণা লাভ করে যেমন, সামনের থেকে কোন খেলনা সরিেেয় নিলেও সে তার কথা ভুলেনা তা পাওয়ার জন্য বায়না ধরে।
- সব শেষে ষষ্ট স্তরে (১৮ থেকে ২৪ মাস) শিশু বহুলাংশে তার মধ্যে জ্ঞানীয় দক্ষতার বিকাশ সাধন করে। এ সময় সে তার মস্তিষ্কের মধ্যে কোন বস্তুর চিত্র ধারণ করতে পারে এবং বস্তুর বদলে প্রতীক ব্যবহার করতে পারে। ভাষার ব্যবহার হচ্ছে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শব্দ শুনে বস্তু দেখাতে পারে এবং আধো শব্দ ব্যবহার করে অনেক রকম মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে।
জেরুম এস, ব্রনার (Jerome S. Bruner) এক নতুন ধারণার অবতারণা জ্ঞান বিকাশের মতবাদ
পিয়াজের জ্ঞানম লক মতবাদের বিকল্প হিসাবে আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী জেরুম এস, ব্রনার (Jerome S. Bruner) এক নতুন ধারণার অবতারণা করেন। তিনি পিয়াজের মত শিশুর অন্তঃস্থ বা জৈব সত্ত্বাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং পরিবেশ ও ভাষা-দক্ষতাকেই শিশুর জ্ঞান বিকাশের পথে সহায়ক উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ব্রনারের মতে জ্ঞান বিকাশের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির কাছে বাস্তব বিশ্বের একটি মডেল বা প্রতিকৃতি (a model of the world and or reality) তুলে ধরা যার সাহায্যে সে তার সমস্যার সমাধান করবে। বিশ্বের প্রতিকৃতির মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য সংগ্রহ করার একটি অন্তঃস্থ ব্যবস্থা। সে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় ব্যক্তির সাথে তার পরিবেশের বস্তু, মানুষ, ভাষা বা ধারণার পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে। অতএব ব্যক্তির এই বিশ্ব প্রতিকৃতি হচ্ছে একটি সুগঠিত মানসিক অবস্থা যা পিয়াজের অন্তঃস্থ কাঠামোর অনুরূপ ব্রনারের মতে বিকাশের বিভিন্ন স্তরে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে তার অর্জিত উপাত্ত বা তথ্য উপস্থাপন করে। যেহেতু মানুষের মডেল এমন সব তথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে তাই ক্রমে ক্রমে এটি পরিবর্তিত হয়ে আরো বৃহত্তর ও বাস্তবিক বিশ্বকে উপস্থাপন করতে পারে অর্থাৎ সহজ থেকে জটিলতর জ্ঞান প্রকাশ করে। যেমন তাৎক্ষণিকভাবে শিশু যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা তার পরবর্তী বিশ্ব প্রতিকৃতিকে বদলে দেয়; আবার এর মাধ্যমে যখন সে নিজেকে প্রকাশ করে তখন তাই আবার তার পরবর্তী বিশ্ব প্রতিকৃতি কি হবে তা নির্ধারণ করে। ব্রনার তাঁর বিশ্ব প্রতিকৃতিকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। তবে ব্রনারের স্তর বিভাগগুলির কোন বয়ঃক্রমিক ব্যবধান নেই।
বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া পর্যায় - The Enactive Mode
প্রক্রিয়া পর্যায় - The Iconic Mode
সাংকেতিক প্রক্রিয়া - The Symbolic Mode