আমিনা বিনতে ওহাব
Table of Content:
আপনার দয়া প্রার্থনা করছি, আমরা এই অপরাধীদের জবান হতে হে আল্লাহ। পরাক্রমশালী, মহামহিম হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কোরআনে পড়েছি আপনার পালনকর্তা আপনার জীবনকে পুরো মানবজাহানের জন্য অনুগ্রহ করেছেন। আমরা আপনাকে অনুভব করি আমাদের হৃদয় দিয়ে। আপনি এখনো আপনার উম্মতের সরদার, আমাদের মাথার তাজ।
আপনি আপনার জন্ম এক মহান পরিবারে যেই পরিবার এত কিছুর মধ্যেও এক ইলাহ আপনার রবকে ত্যাগ করেনি। যারা ইব্রাহিম আর ইসমাইল আলাইহিস সালামের ধর্মকে পরিত্যাগ করেনি। যখন আপনার পিতা জনাব আব্দুল্লাহর বয়স মাত্র ২০-২৫ বছর, তখন আপনার দাদা বানু হাশেমের সরদার আব্দুল মুত্তালিব উনার জন্য কুরাইশের আরেকটি গোত্র বানু জোহরা সরদারের সুযোগ্য কন্যা সম্মানিতা আমিনা বিনতে ওয়াহাবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অতঃপর তাদের বিয়ে খুব দ্রুতই ধুমধামের সাথে সম্পন্ন হয়। আল্লাহ তাদের উভয়ের উপরই রাজি থাকুন, আমিন।
যারা ইব্রাহিমের ধর্মের উপর অবিচল ছিলেন, বিয়ের কিছুদিন পর পরই জনাব আব্দুল্লাহকে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া যেতে হয়। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর ইয়াসিরিবের কাছাকাছি এসে পৌঁছলে তিনি বলেন ইয়াসিরিবে আমার আত্মীয় আছে, আপাতত এখানে কিছুদিন অবস্থান করব। তোমরা মক্কা অভিমুখে রওনা হও।
জনাব আব্দুল্লাহ মূলত তার দাদী বাড়ির কথা বলছিলেন। তার পিতা আব্দুল মুত্তালিবের মাতা ছিলেন ইয়াসরিব শহরের কন্যা। অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিবের পিতা হাশিম ইবনে আব্দে মানাফ ইয়াসরিবের বানু নাজ্জার গোত্রের কন্যা সালমা বিনতে আমরকে বিবাহ করেন। অতএব জনাব আব্দুল্লাহ ইয়াসিরিবের দিকে রওনা হন।
অতঃপর ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কা পৌঁছলে আব্দুল মুত্তালিব কে জানানো হয়, তিনি সুস্থ হলে মক্কা ফিরে আসবেন। আপাতত ইয়াবেই বিশ্রাম নিচ্ছেন, কিন্তু অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলেও তিনি ইয়াসরিবেই ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে ইয়াসরিব থেকে সংবাদ আসে আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০-২৫ বছর। তবে তার কবর বর্তমানে কোথায় তা কেউই জানেনা।
আপনার সম্মানিতা মা হযরত আমিনা মাত্র ১৭-১৯ বছর বয়সে বিধবা হয়েছে, যখন গর্ভে ছিলেন আপনি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনাব আব্দুল্লাহর প্রথম এবং একমাত্র সন্তান। আপনার জন্মগ্রহণের পূর্বেই আপনি আপনার সম্মানিত পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে হারিয়েছেন। আল্লাহ উনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত নসিব করুন।
তবে এতটুকুই সান্ত্বনা যে তিনি জানতেন তার সন্তান কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর আলো দেখবে। তবে তিনি কি এটা জানতেন যে আপনি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং ইসমাইল আলাইহিস সালামের দোয়া আর আপনি শুধু পৃথিবীর আলোই দেখবেন না, বরং আপনি পুরো পৃথিবীকেই আলোকিত করবেন। পুরো মানবজাতি আপনার আলোয় আলোকিত হবে এবং সে আলো কেয়ামত পর্যন্ত আরব এবং আজব সকলেই গ্রহণ করবে।
ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ৩৫০০ বছর আগে যে আলো পুনরায় জ্বালিয়েছেন, আপনি তাকে পরিপূর্ণ করবেন। হযরত আব্দুল্লাহ কি জানতেন তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের গর্বিত পিতা হতে চাচ্ছেন? হয়তো জানতেন না, হয়তোবা আল্লাহ উনাকে জানিয়েছেন কোন স্বপ্নের মাধ্যমে, যেমনটা আপনার পূর্ণবতি মা আগেই কিছুটা করতে পেরেছিলেন।
ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার জন্ম কোন তারিখে হয়েছে তা বলতে না পারলেও আমরা জানি আপনি কি জন্মগ্রহণ করেছেন। কারণ আপনি নিজেই এক সাহাবাকে বলেছিলেন আর সেই দিনটি ছিল সোমবার। আপনি হয়তো জানেন গত কয়েকশো বছর ধরে আপনার জন্মদিন পালন পদ্ধতি নিয়ে বিশাল মতবিরোধ আপনার উম্মতের মধ্যে। কেউ পক্ষেই, কেউ বিপক্ষে। এখন সেদিন মিলাদ হয়, জুলুস বের হয়, আরো কত কি। আমার মনে হয় না আপনি এগুলো মোটেও পছন্দ করেন। তবে যারা আপনার নাম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে, তারা বেশ ধুমধামের সাথেই পালন করে এই দিনটি, অর্থাৎ রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ। যদিও সত্যিকার অর্থেই আমরা জানিনা আপনি কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন।
ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি অবাক হবেন জেনে যে আপনার জন্মগ্রহণ নিয়েও অনেক মিথ্যা গল্প আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে। যেমন একটি ঘটনা, তারা বলেন আপনি নাকি খাতনা করা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অথচ আপনার দাদা আব্দুল মুত্তালিব আপনার জন্মগ্রহণের সপ্তম দিনে আপনার খাতনা সম্পূর্ণ করান এবং তিনি আপনাকে উপাধি দেন মোহাম্মদ। এবং আপনি এই নামেই বেশি পরিচিত দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও।
যদিও আপনার মা আপনার জন্য নাম রেখেছিলেন আহমদ। আসলে আপনার পুরো নাম ছিল আবুল কাসেম মোহাম্মদ আহমদ। আবুল কাসেম ছিল আপনার ডাক নাম, মোহাম্মদ ছিল আপনার উপাধি এবং আহমদ ছিল আপনার আসল নাম। যেটা ছিল আপনার মায়ের দেয়া নাম। সপ্তম দিনে আপনার খাতনা এবং নাম রাখার পর আপনার দাদা সেইদিন বিশাল ভোজ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। অতঃপর কয়েক মাস পর মক্কা সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রথা অনুযায়ী আপনাকে মা হালিমা বিনতে সাদিয়া যিনি তায়েফের বানু সাদ ইবনে বাকার গোত্রে ছিলেন, তার নিকট লালন পালনের জন্য প্রদান করা হয়। কারণ কোরাইশদের ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তানের ভালো পরিবেশে বড় করতে চাইতেন।
যেহেতু তায়েফ এলাকাটি অনেক উঁচুতে এবং তুলনামূলকভাবে শীতল ছিল এবং পরিবেশ অনেক স্বাস্থ্যকর ছিল মক্কার তুলনায়, তাই আর্থিকভাবে সচ্ছল কুরাইশরা তাদের সন্তানদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তায়েফেই লালন পালনের জন্য প্রেরণ করতেন। আর এসকল কারণে বানু সাদ ইবনে বাকার গোত্র মক্কা এবং তার চারপাশের অঞ্চলগুলোতে অনেক বেশি প্রসিদ্ধ ছিল। যেহেতু হালিমা সাদিয়া অন্যান্য কিছু নারীদের ন্যায় নিজেও মা হয়েছেন, তাই তিনিও তার স্বামীর সাথে মক্কাতে যান সন্তান গ্রহণের জন্য যাতে করে এর বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জন হয়।
মা হালিমা সাদিয়ার আরেকটি কন্যা সন্তান ছিল, তার নাম ছিল শাইমা, যিনি সেই সময় সাত-আট বছরের বয়সেই ছিলেন। অতঃপর স্বামীকে নিয়ে মক্কাতে আসার পর মা আমিনার সাথে হালিমা সাদিয়া সাক্ষাৎ হয় এবং উনার কাছেই আপনাকে হস্তান্তর করা হয় দুধ পান এবং লালন পালনের জন্য। মা আমিনা না চাইলেও তাকে এমনটা করতে হয়েছে স্বামীর পর, এবার সন্তান থেকেও দূরে থাকতে হবে। কিন্তু ভবিষ্যৎকে ভেবে তিনি এমনটা করতে রাজি হয়েছিলেন।
পরবর্তীতে মা হালিমা আপনাকে নিয়ে তায়েফের পথে রওয়ানা হন এবং আপনি তায়েফেই বড় হতে থাকেন। প্রতিবছর অন্তত একবার আপনাকে মক্কাতে নিয়ে আসা হতো এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাসখানেক আপনি আপনার মায়ের সাথেই থাকতেন। সাধারণত দুই বছর এভাবে লালন পালনের জন্য রাখা হলেও আপনার প্রতি মা হালিমার ভালোবাসা এবং যত্ন দেখে মা আমিনা আরো কয়েক বছরের জন্য দায়িত্ব দিতে রাজি হন। অতঃপর আপনার বয়স চার বছর হলে আপনি আপনার মায়ের কাছে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন।
আপনার বয়স যখন ছয় বছর, তখন আপনার মা আপনাকে নিয়ে ইয়াসিরিবে যান, যেই শহর একসময় আপনার শহর হিসেবেই সুখ্যাতি পাবে এবং যেখানে আপনার পিতাও শুয়ে আছেন। আপনাদের সাথে আপনার মায়ের একজন দাসী, যার নাম ছিল উম্মে আইমান, তিনিও সঙ্গে ছিলেন। প্রায় কয়েক মাস আপনারা ইয়াসরিবেই ছিলেন। তখন আপনি আপনার মায়ের সাথে আপনার পিতার কবর জিয়ারত করেছিলেন। ইয়াসরিবে দুতিন মাস থাকার পর মক্কা ফেরার পথে আল আবুয়া গ্রামে পৌঁছলে মা আমিনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তিনি সেই গ্রামেই ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ আপনার মা আমিনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত দান করুন। আমিন। উনার ইন্তেকালের পর আল আবুয়া গ্রামের মানুষরাই উনাকে সেখানে কবরস্থ করেন। না জানি সেই দিনটি আপনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে কাটিয়েছেন। মাত্র ছয় বছর বয়স আপনার, অথচ বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছেন। বাবার কবর জিয়ারতের কয়েক মাসের মধ্যেই মাকেও কবরস্থ করতে হয়। আমরা জানি, আপনি সেই দিনটি কখনোই ভুলেননি। এক যুদ্ধের সফর শেষে মদিনায় ফেরার পথে আপনি যখন আল আবুয়া গ্রাম অতিক্রম করছিলেন, তখন আপনি আপনার মায়ের কবর জিয়ারত করেছিলেন। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা আপনি আপনার মায়ের সাথেই সময় কাটিয়েছিলেন।
সেইদিন আপনার কান্না দেখে সকল সাহাবারাও কেঁদে কেঁদে তাদের বুক ভাসিয়েছিলেন। রেওয়ায়েতে বলা আছে, আপনি নাকি সেদিন শিশুদের মত কান্না করেছিলেন। অথচ আপনার বয়স তখন 60 ছুই ছুই। মাকে কবরস্থ করার পর উম্মে আইমান ও অন্যান্যরা যখন আপনাকে নিয়ে মক্কাতে ফিরে আসে, তখন আপনি আপনার প্রিয় দাদার কাছেই বড় হতে থাকেন। আপনার দাদা আপনাকে আপনার মায়ের মতোই আদর করতেন। তার সকল নাতিনাতনীদের থেকে আপনাকে সবচেয়ে বেশি আদর করতেন।
কিন্তু আপনার বয়স যখন আট বছর, তখন তৃতীয়বারের মতো আপনি আবার এতিম হয়ে যান। প্রথমে আপনার শ্রদ্ধেয় বাবা, তারপর আপনার ভালোবাসার মা, আর এখন আপনার প্রিয় দাদা। তবে আপনার দাদা ইন্তেকালের আগেই আপনাকে আপনার আপন চাচা আবু তালেবের হাতে অর্পণ করে যান। আপনার চাচাও আপনাকে নিজের ছেলের মত করেই লালন পালন করেন। এভাবে আপনি এবং আপনার চাচাতো ভাই জাফর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মক্কা নগরীতে একসাথে একত্রেই বড় হতে থাকেন আল্লাহ তাআলার রহমতের ছায়াতলে।