সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ)
বিশিষ্ট সাহাবী সাঈদ ইবনে যায়েদ ('রাযি.')
তখনও ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতে পরিপূর্ণ যুগ। নবীজী ('সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্ত হননি। সমগ্র আরব জুড়ে কুফর ও শিরকের ঘনঘটা বিস্তার ছড়িয়েছে। কিছু কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। কিছু কিছু গোত্রে দু'চারজন এমন লোকও ছিল যাঁর শিরক ও জাহেলী প্রথাকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন। তাঁরা সত্য অন্তরেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং দীনে ইবরাহিমী অনুসরণ করতে চাইতেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত যায়েদ ('রাযি.') এ ধরনের নেক স্বভাবের মানুষই ছিলেন। কুরাইশের প্রখ্যাত কাবিলা বনু আদির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি আমর বিন নুফায়েলের বিন আবদুল উজ্জা বিন রাবাহ বিন আবদুল্লাহ বিন কুরয বিন যারাহ বিন আদ বিন কাব বিন লুব্বী কারাশী পুত্র এবং উমর ('রাযি.')-এর চাচাতো ভাই ছিলেন।
এটা ঠিক যে, যায়েদ (রাযি.) তাওহীদের আকীদায় অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি শুধু মূর্তি পূজা এবং শিরককেই ঘৃণা করতেন না; বরং মূর্তিদের উপর কৃত কুরআনী ও খুনকেও হারাম মনে করতেন। নেতৃস্থানীয় রাবীগণ লিখেছেন, যায়েদ কাব্যেও ব্যুৎপত্তি রাখতেন এবং নিজের কবিতায় প্রকাশ্যভাবেই কুফর ও শিরকের নিন্দা করতেন। তেমনিভাবে তিনি আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত এবং মহানত্বের ব্যাপারেও কবিতা লিখেছেন। এমনিভাবে মূর্তি পূজা এবং জাহেলী প্রথাকে প্রকাশ্য নিন্দা করা এবং লোকদেরকে দীনে ইবরাহিমীর দিকে আহবান জানানোকে কুরাইশরা ঠান্ডা মাথায় বরদাশত করার মত ছিল না। তারা যায়েদের কট্টর দুশমন হয়ে গেল এবং তাঁর উপর যুলুম করার জন্য কোমর বাঁধলো।
বিশেষ করে তাঁর চাচা খাত্তাব উমরের পিতা সবচেয়ে বেশী তৎপর ছিল। সে বিশেষভাবে নির্যাতন করেছিল, যায়েদ টিকতে না পেরে মক্কা থেকেই বের হয়ে গিয়ে হারামে অবস্থান করেন। এ সত্ত্বেও কখনো কখনো লুকিয়ে চুপিয়ে কা'বা যিয়ারতের জন্য মক্কা আসতেন। বিশেষ করে অহী অবতীর্ণ হওয়ার কিছু বছর পূর্বে একবার রাসূল ('সা.') এবং যায়েদের মধ্যে বালদাহ উপত্যকায় সাক্ষাত হয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর মত যায়েদও মূর্তিদের নামে যবেহকৃত পশুর গোশত খেতে অস্বীকৃতি জানান ।
আবদুল্লাহ ইবন উমর ('রাযি.') বলেন, নবীজী ('সা.') বালদার নিম্নাঞ্চলে যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েলের সাথে সাক্ষাত করেন। তখনো তাঁর উপর অহী নাযিল হয়নি। তাঁর সামনে দস্তরখান বিছানো হলো। তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানালেন। অতঃপর যায়েদ বলেন, তোমাদের মূর্তিদের নামে যে পশু যবেহ হয় তা আমি খাই না। আমি সেই পশু খাই যা আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে যবেহ করা হয়। যায়েদ বিন আমর কুরাইশের যবেহকৃত পশুকে খারাপ জেনে বলতো, আল্লাহ তায়ালা বকরী সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তার জন্য আসমান থেকে পানি বর্ষন করেন এবং যমীন থেকে ঘাস উঠিয়েছেন। অতপর তোমরা তা অস্বীকার করে তাকে গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করো এবং তাকে গায়রুল্লাহ সম্মান কর।
বিশেষ করে তখনকার আরবের একটি প্রচলিত নিয়ম ছিলো, জাহেলী যুগে আরবে কন্যা হত্যা একটি সাধারণ রেওয়াজ ছিল। যালেম পিতা নিজের শিশু কন্যাকে জীবিত দাফন করে দিত। যায়েদ এ লোমহর্ষক যুলুমকে প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি যখনই কোন কঠোর অন্তর পিতার এই ইচ্ছার কথা অবগত হতেন তখনই তার নিকট যেতেন এবং কন্যাকে নিজের অভিভাবকত্বে নিয়ে নিতেন। এমনিভাবে তিনি ২০টি নিষ্পাপ শিশু-কন্যার জীবন বাঁচিয়েছিলেন।
আসমা বিনতে আবূ বকর সিদ্দীক ('রাযি.') বলেন, আমি যায়েদ বিন আমরকে বৃদ্ধাবস্থায় দেখেছিলাম। তিনি কা'বার দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, হে কুরাইশরা! আল্লাহর শপথ! আমি ছাড়া তোমাদের মধ্যে কেউই দীনে ইবরাহীমের উপর নেই। যখন কোন ব্যক্তি নিজের কন্যাকে হত্যা করতে চাইতো তখন তিনি বলতেন, হত্যা করো না।
আমি তার ভার বহন করবো। একথা বলে তাকে নিয়ে যেতো। যখন যুবতী হয়ে যেত তখন তার পিতাকে বলতেন তুমি চাইলে তাকে নিয়ে যেতে পারো। নচেৎ আমার নিকটই থাকতে দাও। আমি তার খরচ বহন করবো।
যায়েদ দীনে ইবরাহীমের অনুসন্ধানে সিরিয়া, মুসেল ও জাযিরাহ পর্যন্ত সফল করেন এবং সেখানকার ইহুদী এবং খৃষ্টান আলেমদের সাথে সাক্ষাতও করেন।
এরপরও কাঙ্খিত বস্তুর সন্ধান মেলেনি। কেননা, তাদের ধ্যান-ধারণাও মক্কার মুশরিকদের আকীদা-বিশ্বাসের সাথে সাদৃশ্য ছিল। এতে তিনি হাত উঠিয়ে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো, আমি দীনে ইবরাহীমের উপর রয়েছি। তিনি একথাও বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার ইবাদাতের কোন পদ্ধতি তোমার নিকট পছন্দনীয় তা যদি আমি জানতাম তাহলে আমি সেই পদ্ধতিতেই ইবাদাত করতাম। অতপর তিনি নিজের হাতের উপর মাথা রেখে সিজদা করতেন।
নবীজী ('সা.') নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর পূর্বে জনৈক ব্যক্তি 'বিলাদে লাখাম' নামক স্থানে যায়েদকে হত্যা করে। ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন, ওয়ারাজকাহ বিন নাওফিল তাঁর হত্যার ঘটনার একটি বেদনাদায়ক মরসিয়া রচনা করেন।
তাবেয়ী সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব (রহ.) থেকে বর্ণিত, একবার উমর ('রাযি.') যায়েদের পুত্রের সাথে রাসূল ('সা.') নিকট হাযির হলে বলেন, হে রাসূল! যায়েদের ধ্যান-ধারণার কথা আপনি জানতেন। আমরা কি তাঁর জন্য মাগফিরাত কামনা করবো। তিনি বলেন, আল্লাহ তা'আলা যায়েদ বিন আমরকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর উপর রহমত করুন। তিনি দীনে ইবরাহীমের উপর ইন্তিকাল করেন।
অন্য আরেক রেওয়ায়াতে যায়েদের ব্যাপারে রাসূল ('সা.') বলেন, তিনি কিয়ামতের দিন পৃথক একজন উম্মাত হিসাবে উঠবেন।
যায়েদ বিন আমর বনু খোযায়ার এক মহিলা ফাতিমা বিনতে বাজাকে বিয়ে করেন। তাঁরই গর্ভে সেই মর্দে হকের জন্ম হয়েছিল যিনি পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন। পবিত্র নফস পিতা সেই পুত্রের নাম রেখেছিলেন সাঈদ।
বাস্তবিকই যথার্থ নামই তিনি রেখেছিলেন। আবুল আওয়ার সাঈদ বিন যায়েদ ('রাযি.') যখন জ্ঞান হলো তখন স্বগৃহে সব সময় একক আল্লাহ তায়ালার এবং দীনে ইবরাহীমের আলোচনাই শুনতে পেয়েছিলেন। কিয়ামতের দিন পৃথক এক উম্মাত হিসেবে উত্থিতকারী একত্ববাদে বিশ্বাসী পিতার প্রশিক্ষণে তাঁর অন্তরে তাওহীদের প্রতি গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়।