সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস ('রাযি.')
Table of Content:
বিশিষ্ট সাহাবী সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস ('রাযি.')
রাসূল ('সা.') হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন। এদিকে মুসলমানরা সেসব মুহাজির যাঁরা মক্কায় ১৩টি বছর যাবত কাফেরদের জুলুম-নির্যাতনের যাঁতায় নিষ্পেষিত হয়েছিলেন, কিছুটা শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। মদিনার ইহুদী এবং মক্কায় মুশরিকরা মদিনায় মুসলমানরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে থাকুক তা কোনক্রমেই সহ্য করতে পারলো না। তাঁরা হকপন্থীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা শুরু করেন। মক্কায় কুরাইশরা অন্তরের জ্বালা মিটানোর জন্য মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ বিন উবাইকে একটি উত্তেজনা পূর্ণ চিঠি লিখলো। বিশেষ করে এ চিঠিতে তারা মুনাফিক সরদারকে হুমকি দিল, সে তাদের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রিতকে হত্যা করে ফেলতে হবে অথবা মদিনা থেকে বের করে দিতে হবে। তা যদি না করে তাহলে তারা মদিনায় হামলা করে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। আবদুল্লার যদি সাহস থাকতো তাহলে সে অবশ্যই মক্কায় কুরাইশদের কথামতো কাজ করতো।
যখন তাকে এ ধরনের তৎপরতার পরিণাম সম্পর্কে অবহিত করা হলো তখন সে চুপ মেরে গেল। সময়টি ছিল খুবই ভীতিপ্রদ। ইসলামের দুশমনরা মদিনার ওপর হামলার পরিকল্পনা আটছিলো। এজন্য সদা সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল সুতরাং সাহাবারা একটি নিয়ম করেন। তাঁরা রাতেও অস্ত্র বেঁধে শুতেন এবং পালা করে জেগে জেগে পাহারা দিতেন।
রাসূল ('সা.') আবাস গৃহকে তাঁরা কখনো অরক্ষিত রাখতেন না। রাত হোক অথবা দিন হোক কোন না কোন সাহাবী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রাসূল ('সা.') আবাসগৃহ অবশ্যই পাহারা দিতেন। ঐ সময়ের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হলো, এক রাতে রাসূল ('সা.') ঘুম ভেঙে গেল। ঘটনাক্রমে সে সময় কোন ব্যক্তি পাহারায় ছিলেন না। রাসূল ('সা.') বলেন, হায় আফসোস! কোন নেক ব্যক্তি যদি আজ পাহারায় থাকত। ইতিমধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা গেল। রাসূল ('সা.') জিজ্ঞস করেন, কে? জবাব এলো, হে রাসূল! আমি সা'দ। কি জন্য এসে বলেন, আমার অন্তরে রাসূল ('সা.') ব্যাপারে ভয় সৃষ্টি হলো। এজন্য পাহারা দিতে এসেছি।
রাসূল ('সা.') এ জবাব শুনে খুশী হয়ে গেলেন। সা'দ ('রাযি.)-এর জন্য দোয়া করেন এবং পুনরায় আরাম করতে গেলেন, এ সা'দ ('রাযি.') যাঁকে রাসূল ('সা.') রাজুলে সালেহ বা নেক ব্যক্তির লকব প্রদান করেন। তিনি ছিলেন আবি ওয়াক্কাস মালিক বিন ওয়াহিবের পুত্র এবং কুরাইশের এক সম্মানিত শাখা বনু যাহরার নয়নমনি।
সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাযি)-এর বংশ পরিক্রমা
আবু ইসহাক সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস ('রাযি.') আসহাবে আশারায়ে মুবাশারার অন্যতম ছিলেন এবং ইসলামের ইতিহাসের ব্যক্তিদের মধ্যে পরিগণিত হয়ে থাকেন। তাঁর নসবনামা হলো- সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস ('রাযি.') মালিক বিন ওয়াহিব বিন আবদি মান্নাফ বিন যাহরাহ বিন কিলাৰ বিন মুররাহ।
আর পঞ্চম পুরুষে কিলাম বিন মাররাহ'র ওপর তাঁর নসবের সিলসলিা রাসূল ('সা.') নসবনামার সাথে মিলে যায়। রাসূল ('সা.') মাতা আমেনারও বনু যাহরাহ গোত্রভুক্ত ছিলেন এবং সা'দ ('রাযি.')-এর পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিকের চাচাতো বোন ছিলেন। এ দিক থেকে আবূ ওয়াক্কাস মালিক সম্পর্কে রাসূল ('সা.') মামা হতেন এবং সা'দ ('রাযি.') মামাতো ভাই- রাসূল ('সা.') কখনো কখনো ভালোবাসা ও স্নেহের বশবর্তী হয়ে নানার দিককার সম্পর্কের কারণে সা'দকেও ('রাযি.') মামা বলে ডাকতেন। সা'দের ('রাযি.') মাতার নাম ছিল হাসনা বিনতে সুফিয়ান বিন উমাইয়া এবং তিনি বনু উমাইয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন।
নবীজী ('সা.') হিজরতের প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে সা'দ ('রাযি.') মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল ('সা.') নবৃওয়াত প্রাপ্তির সময় সা'দ ('রাযি.') ছিলেন পূর্ণ যুবক এবং সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ কিংম্বা ১৯ বছর।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সুন্দর স্বভাব ও প্রকৃতি দান করেন। যেই তাঁর কানে তাওহীদের দাওয়াত এলো, তখনই কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তাতে সাড়া দিলেন এবং সাবিকুনাল আউয়ালুনের পবিত্র দলে শামিল হয়ে গেলেন।
পক্ষান্তরে ইসলাম গ্রহণকারী বালেগ পুরুষদের মধ্যে তিনি তৃতীয় মুসলমান ছিলেন এবং অন্য কতিপয় রেওয়ায়াত অনুসারে তাঁর পূর্বে ৬-৭ জন বুজুর্গ ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। যাহোক তিনি পবিত্র সেই কতিপয় নফসের অন্তর্ভুক্ত যারা দাওয়াতে হকের প্রথম সাত দিনের মধ্যে তাওহীদের ঝান্ডা তুলে ধরার মর্যাদা লাভ করেন ।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সা'দ ('রাযি.)-এর মাতা হামনার নিজের বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি সেই ধর্মের প্রতি দিওয়ানা ছিলেন। তিনি যখন পুত্রের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলেন তখন এতো দুঃখিত হলেন, খানা-পিনা, কথা বলা, চলা-ফেরা সবই ত্যাগ করেন। সা'দ ('রাযি.') মাকে খুব গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং নিজের মাকে বিষাদপূর্ণ দেখাটা তাঁর জন্য একটা বড় ধরনের পরীক্ষার ব্যাপার ছিল। তাছাড়া তিনি সে পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হন। যা তিন দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর রলেন। তাঁর একটিই বায়না ছিল, এই নতুন ধর্ম পরিত্যাগ করো। সা'দ ('রাযি.')-এর একই জবাব ছিল মা, তুমি আমার সীমাহীন প্রিয়! তাছাড়া তোমার দেহে যদি হাজার জীবনও থাকে এবং এক এক করে প্রতিটি জীবন বের হয়ে যায় তবুও আমি ইসলাম ত্যাগ করবো না।
আল্লাহর নিকট সা'দ ('রাযি.')-এর অটলতা ও দৃঢ়তা এমনভাবে গৃহীত হলো, সাধারণ মুসলমানের জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন :
وَإِنْ جَاهَدُكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
তারা যদি আমার সাথে এমন কোন শরীক বানানোর জন্য যাকে তুমি জান না তোমার ওপর চাপ দেয়, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না।'[১]
ইসলাম গ্রহণের পর মায়ের অসন্তুষ্টি ছাড়া মুশরিকদের হাতের আরো অনেক কঠিন মুসিবত সা'দ ('রাযি.')-কে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি কাফেরদের গালি খেয়েছেন, অপবাদ সয়েছেন এবং দৈহিক শাস্তিও বরদাশত করেন। তাছাড়া সামান্যতম পদস্খলনও হয়নি।
১. লোকমান: ১৫।