- Aপঞ্চম হিজরী
- Bষষ্ঠ হিজরী
- Cচতুর্থ হিজরী
- Dদ্বিতীয় হিজরী
পঞ্চম হিজরী
এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ইয়াহুদীরা। ঘটনার বিবরণ এই যে, বনী নাদীর ও বনী ওয়াইলের কিছু লোক মক্কায় যায় এবং কুরায়শদের সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে ও উত্তেজিত করতে শুরু করে। কুরায়শদের এ ধরনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল এবং তারা বহু আগে থেকেই এর ফল ভোগ করে আসছিল । এজন্য তারা এর সাহস করছিল না। কিন্তু ইয়াহূদীদের প্রতিনিধি দলটি অবস্থাকে অত্যন্ত অনুকূল ও উপযোগী করে তাদের সামনে তুলে ধরে । তারা এও আশ্বাস দেয় যে, এমতাবস্থায় আমরা আপনাদের সাথেই থাকব এবং যতদিন না এই দীনকে জড়েমূলে উৎসাদন করতে পারব ততদিন আমরা দম নেব না। এ কথায় কুরায়শরা খুব খুশী হয় এবং আনন্দাতিশয্যে তাদের এই আহ্বান কবুল করে। সকলেই এ বিষয়ে একমত হয় এবং সমর প্রস্তুতিতে লেগে যায়। প্রতিনিধি দল এখান থেকে বেরিয়ে গাতাফান গোত্রে গমন করে এবং তাদেরকেও এই যুদ্ধে শরীক হওয়ার আহ্বান জানায়। তাদের বিভিন্ন গোত্রের ভেতর ঘুরে ফিরে মদীনার ওপর হামলার নতুন পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে তাদের সামনে তুলে ধরে এবং কুরায়শরা যে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যুদ্ধে আসছে সে বিষয়েও সবাইকে অবহিত করে। [১]
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 266]
এই সকল প্রয়াসের ফলে তাদের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি হয় যার গুরুত্বপূর্ণ শরীক ছিল কুরায়শ, ইয়াহুদী ও গাতফান গোত্র। তারা আরও কিছু শর্তের ব্যাপারেও একমত হয় যার ভেতর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল এই যে, গাতাফান গোত্র এই মিত্র বাহিনীতে ছয় হাজার সৈন্যসমেত অংশ নেবে। এর বিনিময়ে ইয়াহুদীরা গাতাফান গোত্রকে খায়বারের ব্লগানগুলোর গোটা বছরের ফসল প্রদান করবে। মোটের ওপর কুরায়শরা চার হাজার যোদ্ধা এতদুদ্দেশ্যে সমবেত করে, গাতাফান করে ছয় হাজার। আর এ সংখ্যা সাকুল্যে দাঁড়ায় দশ হাজারে। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় আবূ সুফিয়ানকে। [২]
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 266]
এবার হযরত সালমান ফারসী (রা) মদীনার সামনে ১ খন্দক (পরিখা) খননের পরামর্শ দিলেন। এটি ছিল ইরানীদের অতি পরিচিত সামরিক কর্মকৌশল । হযরত সালমান (রা) আরজ করেন : হে আল্লাহ্র রাসূল! ইরানে যখন আমরা অশ্বারোহী বাহিনীর হামলার আশংকা করতাম তখন আমরা তাদের মুকাবিলায় খন্দক খনন করতাম । রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর এই অভিমত অত্যন্ত পসন্দ করেন এবং মদীনার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ময়দানে খন্দক খননের নির্দেশ দিলেন। এটি ছিল সেই খোলা অংশ যেখান থেকে শত্রু মদীনার ভেতরে প্রবেশের সহজ সুযোগ পেতে পারত ।
রাসূলুল্লাহ (সা) খন্দক খননের কাজ তাঁর সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে এভাবে বণ্টন করে দিলেন যে, প্রতি দশজনের ভাগে চল্লিশ (৪০) হাত খননের দায়িত্ব বর্তায় ।৩ খন্দকের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫ (পাঁচ) হাজার হাত, গভীরতা সাত থেকে দশ হাত এবং প্রস্থ সাধারণভাবে নয় হাতের কিছু বেশি হবে।
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 267]
কাফির ও মুসলিম বীরের শক্তি পরীক্ষা রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাথে সমস্ত মুসলমানই সেখানে (ছাউনি ফেলে) অবস্থান করলেন । দুশমন তাঁদেরকে অবরোধ করে রেখেছিল, কিন্তু অবস্থা তখনও যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি। অবশ্য শত্রুর দুই-একজন অশ্বারোহী সৈনিক ঘোড়া ছুটিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছে এবং খন্দক প্রান্তে এসে থেমে গেছে। তারপর গভীর খন্দকদৃষ্টে বলাবলি করেছে যে, এ যে দেখছি এক নতুন কৌশল, নতুন জাল বিছানো হয়েছে, এরা যার সঙ্গে পরিচিত নয়। এরপর এভাবে তাদেরই একটি দল খোঁজ করতে করতে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছে যেখানে খন্দকের প্রশস্ততা খুবই কম ছিল। সেখানে পৌছে তারা ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতা মারতেই ঘোড়া এক লাফে খন্দক পেরিয়ে চলে এল এবং মদীনার ভূখণ্ডে দৌঁড়ে বেড়াতে লাগল । এই দলের মধ্যে আরবের প্রখ্যাত অশ্বারোহী বীর আমর ইবন আবদুদও ছিল যাকে এক হাজার অশ্বারোহী সৈনিকের সমকক্ষ গণ্য করা হত। সে এক স্থানে থেমে হাঁক ছাড়ল : আছে এমন কেউ যে আমার মুকাবিলা করবে? এতদশ্রবণে হযরত আলী (রা) তার সামনে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন : আমর! তুমি আল্লাহ্র সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিলে যে, কুরায়শদের কেউ তোমাকে দু'টো বিষয়ে দাওয়াত দিলে তার একটি তুমি অবশ্যই কবুল করবে। 'আমর স্বীকার করল এবং বলল, হ্যাঁ, আমি এ কথা বলেছিলাম। হযরত আলী (রা) বললেন : ঠিক আছে। আমি তোমাকে আল্লাহ্, তদীয় রাসূলের ও ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। সে বলল : আমার এর কোন প্রয়োজন নেই। হযরত আলী (রা) বললেন : তাহলে আমি তোমাকে মুকাবিলার দাওয়াত দিচ্ছি। সে তখন বলতে লাগল : ভাতিজা আমার! আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। হযরত আলী (রা) বললেন : কিন্তু আল্লাহ্র কসম! তোমাকে আমি অবশ্যই হত্যা করতে চাই।
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 272]
উম্মুল-মু'মিনীন হযরত আয়েশা (রা) সে সময় বনী হারিছার দুর্গে অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। তখন পর্যন্ত পর্দার হুকুম নাযিল হয়নি। তিনি বর্ণনা করেন, সা'দ ইবন মু'আয (রা) একদিন দুর্গের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন এত ছোট লৌহবর্ম পরিধান করেছিলেন যে, তাঁর গোটা হাতটাই ছিল এর বাইরে। তিনি রণসঙ্গীত গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। তাঁর মা তাঁকে এ অবস্থায় দেখে বলেন : বেটা! তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছ, তাড়াতাড়ি যাও। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, আমি তাকে বললাম : উম্মু সা'দ (সা'দ-এর মা)! আল্লাহ্র কসম, আমার মন বলছে সা'দ-এর লৌহবর্ম এর চেয়ে যদি আরেকটু বড় হত । অনন্তর তাই হল যার আশঙ্কা হযরত আয়েশা (রা) প্রকাশ করেছিলেন । এই খোলা হাতের ওপর একটা তীর এমনভাবেই এসে লাগল যে, তাতে হাতের মূল শিরাটাই কেটে গেল। ফলে তিনি এই আঘাতের পরিণতিতে বনী কুরায়জা অভিযানে শাহাদাতবরণ করেন।
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 273]
মুসলিম বাহিনী তীর-ধনুক নিয়ে সদাপ্রস্ত্তত থাকেন, যাতে শত্রুরা পরিখা টপকে বা ভরাট করে কোনভাবেই মদীনায় ঢুকতে না পারে। মুসলিম বাহিনীর এই নতুন কৌশল দেখে কাফের বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। ফলে তারা যুদ্ধ করতে না পেরে যেমন ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে, তেমনি রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে আতংকিত হ’তে থাকে। মাঝে-মধ্যে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ১০ জন নিহত হয়। অমনিভাবে তাদের তীরের আঘাতে মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন’।[2] উক্ত ৬জন হ’লেন, আউস গোত্রের বনু আব্দিল আশহাল থেকে গোত্রনেতা সা‘দ বিন মু‘আয, আনাস বিন আউস ও আব্দুল্লাহ বিন সাহল। খাযরাজ গোত্রের বনু জুশাম থেকে তুফায়েল বিন নু‘মান ও ছা‘লাবাহ বিন গানমাহ। বনু নাজ্জার থেকে কা‘ব বিন যায়েদ। যিনি একটি অজ্ঞাত তীরের মাধ্যমে শহীদ হন (ইবনু হিশাম ২/২৫২-৫৩)। এঁদের মধ্যে আহত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বনু কুরায়যা যুদ্ধের শেষে মারা যান (ইবনু হিশাম ২/২২৭)।
(২) পরিখা খননের সময় মুহাজির ও আনছারগণ প্রত্যেকেই সালমান ফারেসীকে নিজেদের দলভুক্ত বলে দাবী করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, سَلْمَانُ مِنَّا أَهْلَ الْبَيْتِ ‘সালমান আমাদের পরিবারভুক্ত’ (হাকেম হা/৬৫৪১; ইবনু হিশাম ২/২২৪)। বর্ণনাটির সনদ যঈফ। আলবানী বলেন, বরং খবরটি আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। যা মওকূফ ছহীহ। বর্ণনাটি হ’ল, আলী (রাঃ)-কে বলা হ’ল, আমাদেরকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথীদের বিষয়ে বর্ণনা করুন। জবাবে তিনি বললেন, তাঁদের কার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাস করছ? তারা বলল, সালমান। তিনি বললেন, তিনি প্রথম যুগের এবং শেষ যুগের ইল্ম প্রাপ্ত হয়েছেন। যা এমন এক সমুদ্র, যার তলদেশ পাওয়া যায় না। তিনি আমাদের পরিবারভুক্ত’ (যঈফাহ হা/৩৭০৪-এর আলোচনা; মা শা-‘আ ১৬৫ পৃঃ)।
শেষাবধি আল্লাহ তা'আলার মদদ দেখা দিল। কাফির মুশরিকদের ফৌজ ও ইসলাম দুশমনদের বাহিনীর ওপর শীতের রাতে এমন প্রবল শৈত্যপ্রবাহ শুরু হল যে, তাদের তাঁবুগুলো উপড়ে গেল, ডেকচিগুলো উল্টে গেল। এতদুদ্দেশ্যে আবৃ সুফিয়ান বললেন : কুরায়শগণ! এখন আর এখানে অবস্থান করার মত নেই। আমাদের খচ্চর ও ঘোড়াগুলো শেষ হয়ে গেছে। বনূ কুরায়জা আমাদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে এবং খুবই ভয়ংকর ও কষ্টদায়ক খবর আমরা তাদের সম্পর্কে পেয়েছি । এই প্রবল শৈত্যপ্রবাহ যে কেয়ামত সৃষ্টি করেছে তাও তোমরা দেখতে পাচ্ছি। ডেকচি পর্যন্ত চুলার ওপর টিকছে না। আগুন জ্বালাতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের কোন অবস্থান ও আশ্রয়স্থলই নিরাপদ ও অক্ষত নেই। এখন এখান থেকে বেরিয়ে পড়। আমি ফিরে যাবার ইচ্ছা করেছি। এই বলে আবু সুফিয়ান তার বাঁধা উটের নিকট গেলেন, তার পিঠে চড়ে বসলেন, পাশে গুঁতা মারলেন। অতঃপর উট খাড়া হতেই তিনি এর রশি খুলে দিলেন।
গাতাফান এই খবর পেতেই যে, কুরায়শরা স্বদেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেছে, নিজেরাও যে যার বাড়িঘরের পথ ধরল। রাসূলুল্লাহ (সা) সে সময় নামায পড়ছিলেন । হুযায়ফা ইবনুল-য়ামান (রা) (যাঁকে তিনি সম্মিলিত বাহিনীর ভেতর গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি রাসূল (সা)-কে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করতে পারেন] এ সময় প্রত্যাবর্তন করেন । তিনি যা কিছু দেখেছিলেন সে সম্পর্কে রাসূল আকরাম (সা)-কে অবহিত করেন।
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - পৃষ্ঠা নম্বর: 274-75]
পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে
[তথ্যসূত্র: নবীয়ে রহমত - সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম - সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী - আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত - "আহযাব যুদ্ধ " এবং বনী কুরায়জা যুদ্ধ নামক অধ্যায় থেকে]